গুহ্যকথা : অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | গপ্পো | ১৮ মে ২০২০ | ৩৩১৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ১৩
লোকটা হাত নেড়ে বলে, বাতাস না, বাতাস না—ওসব হল গুহ্য কথা—বুঝলেন কিনা! কানের পাশ দিয়ে ফিসফিস করে বয় আর বলে যায়, সাবধান, সাবধান!
লোকটা চোয়াল শক্ত করে বলে, হোমে দুটি ছেলে থাকে না? মাজু আর কেল্টু? হারামির হাড় একটা! এই তো সেদিন এদিকের পরিচিত পাগল, নিত্যকে পিটিয়ে মেরে দিল—কেউ কিছু করল না, জানল না, বুঝল না—মেরে খালের জলে ভাসিয়ে দিল দেহ—গুহ্যকথা, গুহ্যকথা!
ডিসেম্বর : অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ইস্পেশাল : উৎসব | ১৯ অক্টোবর ২০২০ | ৩৩৪৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
শিউলিকে বোঝাতে পারি না, যা দেখি তা নয়—সত্য তাই যা আমরা দেখি না। সে তখন হো হো করে হাসে। বলে, তুমি সেই তেমনি রয়ে গেলে—আগের মতই। পাল্টালে না, বদলালে না—এমন লোককে নিয়ে আর পারি না। ওকে বলি, এমন কথা তো ছিল না শিউলি। কথা ছিল, তোমাকে একটি নদী উপহার দেব। সঙ্গে একটি নৌকা। নদীতে ভেসে যাবে নৌকা, জলের উপর সূর্যাস্তের আলো—এমতাবস্থায় কত পাখি উড়ে যেতে পারে আকাশ দিয়ে—কল্পনা করে দ্যাখো একবার।
ও বলে, আমি কল্পনা করতে পারি না। তুমি যা তোমাকে আমি তাই দেখি। দেখি শুনি, একা-একা কথা বলি। তার মধ্যে নদী নেই, সূর্যাস্ত নেই, নৌকা নেই। মাটির দোতলাবাড়ি’র পিছনে আমাদের চাষজমি। আমরা সেখানে মৌরি চাষ করি। ধনে আর জিরে। এই যে চাষজমি, এই যে চাষজন্ম—যেন তা আমাদের হাতে আছে অনন্তকাল। চাষ করতে করতে আমরা যখন সেই মাটির নীচে চলে যাই—দেখি সেখানে প্রাচীন জ্যোৎস্নাসকল পড়ে আছে।
আর আমি অবাক হয়ে যাই শিউলির কথায়। এই তো কী সুন্দর কবিতার মত কথা বলে সে, কবিতার মতন চলন তার—কবিতার মত জীবন। অথচ সে বলে, আমি কবিতা লিখতে পারি না, কারণ আমি তা লিখিনি কখনও। কবিই সত্য আর জগত মিথ্যে—একথা তাকে বোঝাতে পারি না। সে একপাক ঘুরে গিয়ে বলে, ওসব হল তোমার কল্পনা। কবি হয়েই হয়েছে তোমার মুসকিল। জানো তো, কবিরা গজদন্তমিনারে বাস করে? আবোলতাবোল লেখে—আসলে ওসব কোনো কবিতাই নয়! অবাক হয়ে বলি, এসব কী বলছ তুমি শিউলি? জানো আমি কী ঠিক করেছি? এই গোটা ডিসেম্বর মাসটা তোমাকে উপহার দিতে চাই। একী কম কথা হল?
হাত উল্টে শিউলি বলে, ঠিক আছে, দিলে না-হয়—কিন্তু তার পর? এই গোটা ডিসেম্বর নিয়ে আমি কী করব? ডিসেম্বরের সমস্ত শিশির আমার গায়ের উপর ঝরবে। সমস্ত শীত আমাকে কাঁপাবে। প্রজাপতিরা আমার গায়ে বসবে। বলো, তখন আমি কী করব?
কোম্পানির কাগজ : অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ইস্পেশাল : ইদের কড়চা | ১৩ মে ২০২১ | ৩২২৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ২২
রাস্তার ধারেই বাড়ি ছিল আমাদের। তখন গ্রামের কাঁচা রাস্তা। বর্ষায় জঘন্য কাদা। গরমে এই ধুলো। আর হেমন্তে সে মাখামাখি থাকত শিশিরে। একদিন একটা লোক, সঙ্গে চটপটে লোকের দশজনের একটা টিম, যারা ফিতে দিয়ে রাস্তা মাপছিল। যারা সরকারি রাস্তার জায়গা দখল করে বাড়ি করেছে, তাদের বাড়ি ভেঙে রাস্তা বের করে নেবে সরকার। আমাদের মাটির ঘরের অর্ধেকটা ভাঙা পড়বে। কানে পেনসিল গোঁজা লোকটা জানিয়ে দিল। দাদু বলল, একশ বছর আগের এই আমাদের মাটির ঘর। এখন এই তুমি দুদিনের ছোকরা এসে বলছ ভেঙে দেবে? ব্রিটিশ আমলের ঘর কি এখন ভাঙা যায়? সরকারি লোক গম্ভীর মুখে বলে, মাপে যা বেরিয়েছে, সেটা আমি কেবল জানিয়ে গেলুম। এবার প্রশাসন বুঝবে।
সই : অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | গপ্পো | ১৩ অক্টোবর ২০২১ | ১৮১৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
প্রথমদিন তিস্তা লাহিড়ি’র দিকে একঝলক তাকিয়েই মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল শুভশ্রী’র। ভদ্রমহিলাকে যখন দেখে সে, একেবারে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল, এমনিই ব্যক্তিত্ব তাঁর। পরনে ছিমছাম একটি তাঁতশাড়ি, মুখে হালকা প্রসাধন, চোখে শৌখিন ফ্রেমের চশমা। গায়ের রঙ এই বয়সেও যেন ফেটে পড়ছে। চুল কালার করা, কালোর সঙ্গে মেরুন রঙ। বেশ লাগে তাঁকে দেখতে।
তিনি ইজিচেয়ারে বসেছিলেন। তাঁর বসাটা এমন জায়গায় ছিল, যেখান থেকে বাইরে-ভেতর দেখা যায়। তিনি দু’হাত বাড়িয়ে তাকে গ্রহণ করলেন। শুভশ্রী দু’হাত তুলে ‘নমস্কার ম্যাডাম’ বলতেই তিনি এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, এসো এসো, আমার সই।